লকডাউনসহ নানা বিধিনিষেধ আরোপ করেও করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু ঠেকাতে পারছে না দেশগুলো। ফলে স্থবির হয়ে যাওয়া অর্থনীতি ও জনজীবনকে কিছুটা হলেও স্বাভাবিক করতে অনেক দেশই ঝুঁকি সত্ত্বেও লকডাউন শিথিল করেছে। খুলছে দোকানপাট, রেস্টুরেন্ট, অফিস-আদালত। দীর্ঘদিন ঘরবন্দি থাকা মানুষ আবার ভিড় করতে শুরু করেছে এসব জায়গায়। যদিও অনেক ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত থাকায় এতেই নতুন করে সৃষ্টি হয়েছে গণসংক্রমণের শঙ্কা। ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্স, রাশিয়া, ভারতসহ অনেক দেশেই লকডাউন শিথিল হওয়ার পরে সংক্রমণের সংখ্যা হঠাৎ করেই বেড়ে যাওয়া এ শঙ্কাকে যেন আরও সত্য করে তুলছে। আবার যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের মতো যে দেশগুলো এখন লকডাউন তোলার পরিকল্পনা করছে তাদের জন্যও এটি সতর্ক বাতা বয়ে এসেছে। এর আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও (ডব্লিউএইচও) সব দেশকে হুশিয়ার করে বলেছে, যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে ধাপে ধাপে লকডাউন তোলা না হলে করোনার পুনসংক্রমণের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যান সাইট ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্যানুযায়ী, গতকাল বৃহস্পতিবার রাত ৮টা পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৪৪ লাখ ৫৫ হাজার ছাড়িয়েছে ও মৃতের সংখ্যা তিন লাখ ছুঁই ছুঁই করছে। এখনো বিশ্বে আক্রান্ত ও মৃত্যুর দিক থেকে শীর্ষে আছে যুক্তরাষ্ট্র। গতকাল পর্যন্ত দেশটিতে আক্রান্তের সংখ্যা ১৪ লাখ ৩০ হাজার ও মৃতের সংখ্যা ৮৫ হাজার ছাড়িয়েছে। গত বুধবারও ২৪ ঘণ্টায় দেশটিতে প্রাণ গেছে ১৭৭২ জনের, নতুন আক্রান্ত হয়েছে ২১ হাজার ৭১২ জন। এ ছাড়া আক্রান্তের দিক থেকে পরবর্তী চার অবস্থানে আছে স্পেন (২৭২৬৪৬), রাশিয়া (২৫২২৪৫), যুক্তরাজ্য (২২৯৭০৫) ও ইতালি (২২২১০৪)। মৃত্যুর দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পরের চার অবস্থানে আছে যুক্তরাজ্য (৩৩১৮৬), ইতালি (৩১১০৬), স্পেন (২৭৩২১) ও ফ্রান্স (২৭০৭৪)।
যুক্তরাষ্ট্রে করোনা পরিস্থিতি ক্রম অবনতির মধ্যেই সম্প্রতি অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে লকডাউন শিথিলের পক্ষে কথা বলে আসছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কিন্তু এ নিয়ে অযথা তাড়াহুড়ো করলেই যে বিপদ আরও বাড়বে তা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন দেশটির শীর্ষ সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অ্যান্টনি ফসি। গত বুধবার মার্কিন সিনেটের শুনানিতে তিনি বলেন, ‘তাড়াহুড়োর জেরে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে গেলে অর্থনীতি তো মুথ থুবড়ে পড়বেই, আরও বেশি মানুষের ভোগান্তি হবে, বাড়বে মৃত্যুও।
ফসির আশঙ্কা যে অমূলক নয়, তার প্রমাণ মিলছে বিশ্বের নানা প্রান্তেই। যেমন জার্মানি কিছুদিন আগে করোনা মোকবিলায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। তাই ইউরোপের দেশটি লকডাউন শিথিল করতে শুরু করেছে। কিন্তু তাতেই সংক্রমণের গ্রাফ গত তিন দিনে ফের ঊর্ধ্বমুখী। গত বুধবারের রিপোর্ট বলছে, দেশটিতে ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত বেড়েছে প্রায় হাজারের কাছাকাছি, মারা গেছে ১২৩ জন। দেশটি শুধু তিন কসাইখানা থেকেই মঙ্গলবার ৩৩৬ জনের শরীরে নতুন করে সংক্রমণ ধরা পড়েছে। জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মের্কেল পার্লামেন্টে বলেছেন, এই ভাইরাসকে নিয়েই চলতে হবে আমাদের। আবার নিষেধাজ্ঞায় ফেরা মানে, অবসাদ বাড়বে।
আবার লকডাউন শিথিলের পর থেকেই ইউরোপে করোনা সংক্রমণের নতুন হটস্পটে পরিণত হয়েছে রাশিয়া। গত বুধবারও সেখানে ২৪ ঘণ্টায় ১০ হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে, মারা গেছে ৯৬ জন। প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন তবু অর্থনীতি সচল রাখতে লকডাউন তোলার পথেই হাঁটছেন। ফ্রান্সেও লকডাউন শিথিল হওয়ার পর সংক্রমণ বেড়েছে। দেশটিতে আক্রান্তের সংখ্যা এই বাড়ছে তো এই কমছে। গত ১০ মে দেশটিতে নতুন রোগী পাওয়া গিয়েছিল ৩১২ জন। ১১ ও ১২ মে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৫৩ ও ৬৩৭ জনে। এই সংখ্যা ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে।
চীনেও নতুন করে ১৫ জনের শরীরে সংক্রমণ মিলেছে। দক্ষিণ কোরিয়াতেও ফের মিলেছে গুচ্ছ সংক্রমণের ইঙ্গিত। হংকংয়ে নতুন করে ছড়াচ্ছে স্থানীয় স্তরে সংক্রমণ। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনও এখন লকডাউন তোলায় মেপে পা ফেলার পক্ষপাতী। তিনি বলছেন, সংক্রমণ কমাতে যুক্তরাজ্য জান লড়িয়ে দিয়েছে। কোনোভাবেই সংক্রমণের দ্বিতীয় ঝড় উঠতে দিতে পারি না।
এশিয়াতে করোনার থাবায় বিপর্যস্ত দেশগুলোর মধ্যে তুরস্ক, ইরান ও ভারত অন্যতম। এই তিন দেশই লকডাউন শিথিল করেছে। কিন্তু তিন দেশেই প্রতিদিন রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। বুধবারও তুরস্কে ১৬৩৯, ইরানে ১৯৫৮ এবং ভারতে ৩৭৬৩ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে। এদিন তুরস্কে ৫৮, ইরানে ৫০ ও ভারতে মারা গেছে সর্বোচ্চ ১৩৬ জন।
এর আগে ডব্লিউএইচও লকডাউন শিথিলের ক্ষেত্রে দেশগুলোকে ৬টি শর্ত আবশ্যিকভাবে মেনে চলার আহ্বান জানায়। সেগুলো হলোÑ জোরদার নজরদারি, রোগীর সংখ্যা কমা ও সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসতে হবে। প্রত্যেক রোগী চিহ্নিত, পৃথককরণ, পরীক্ষা ও চিকিৎসা করা এবং রোগীর সংস্পর্শে আসা সব ব্যক্তিকে শনাক্ত করার সক্ষমতা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার থাকতে হবে। স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র ও নার্সিং হোমের মতো বিশেষ ব্যবস্থাগুলোয় সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকি কমে আসতে হবে। কর্মস্থল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং অন্য যেসব জায়গায় মানুষকে যাতায়াত করতে হয়, সেসব স্থানে প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে হবে। বিদেশ ফেরত ব্যক্তিদের মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকি মোকাবিলার প্রস্তুতি থাকতে হবে। সবশেষ শর্ত হলোÑ সমাজের সবাইকে সজাগ ও সংশ্লিষ্ট করতে হবে এবং এর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে তাদের ক্ষমতায়ন করতে হবে। কিন্তু সমস্যা হলো লকডাউন শিথিল হওয়া বেশ কয়েকটি দেশই এসব শর্তের অনেকগুলো এখনো পূরণ করতে পারেনি।